বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যা বাংলাদেশিদের মধ্যে, বিশেষ করে কক্সবাজারে বসবাসকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
স্থানীরা জানান, সামাজিক ও যৌন রোগ সম্পর্কে না জানা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ রোগের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক মাসে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মধ্যে এইচআইভি এবং যৌন সংক্রমণের জন্য এইডস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
এদিকে, কক্সবাজার, বিএসএমএমইউ, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার পাঁচটি বড় হাসপাতাল এবং দেশের ২৫টি কেন্দ্রে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, যা খুবই অপ্রতুল। এমনকি দেশের বৃহত্তম ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অধিকাংশ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে এইডসের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। যদিও, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রে এই পরিষেবা দেওয়া হয় তবে দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এটি অপর্যাপ্ত। এর পাশাপাশি প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা রোগের বিস্তার নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে বসবাসকারী অন্তত ৩৯৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী ভাইরাসে আক্রান্ত। এ বছর ১০৫ জনের মধ্যে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এইচআইভি সংক্রমণের কারণে এখনও পর্যন্ত ১৯ জন মারা গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত নিহতের সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। এ রোগের বিস্তার রোধে এখনই সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসার মাত্র দুই মাস পর বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা পরীক্ষা সম্পন্ন করে। সেই সময়ে, এইচআইভি মাত্র ৮৫ জনের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রকাশনা এবং ল্যাঙ্ক্যান্ট একটি জরিপ পরিচালনা করে। রির্পোটে প্রকাশ করেছে যে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করা হয়েছে যে আগস্ট, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ২৭৩ জন রোহিঙ্গার মধ্যে এইচআইভি পাওয়া গেছে।
৮ মার্চ, ২০১৯ তারিখে সংখ্যাটি ৩১৯ এ দাঁড়িয়েছে যখন অনেক লোকের পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। এইচআইভি আক্রান্ত ৩১৯ জনের মধ্যে অন্তত ২৭৭ জন এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করার পরে চিকিত্সা শুরু করেছেন এবং তাদের মধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন। করোনার কারণে নতুন করে রোহিঙ্গাদের এইচআইভি স্ক্যানিং বন্ধ আছে, তবে খুব শিগ্রই সরকার ও বেসরকারী উন্নয়ন সহযোগিরা কাজটি শুরু করবেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৩৯৫ জন রোহিঙ্গা এইচআইভিতে আক্রান্ত।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ার পিছনে সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন যদিও সামাজিক কুসংস্কারও রয়েছে। এসবই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। অন্যান্য সমস্ত রক্ষণশীল সমাজের মতো, যখন তাদের শরীরে এইচআইভি শনাক্ত হয় তখন ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে যখন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে অলসতা দেখান। কক্সবাজারের চিকিৎসক মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, “অনেক রোহিঙ্গা এইচআইভিকে জ্বর ও সর্দি-কাশির মতো একটি সাধারণ অসুখ মনে করে।
ঢাকা ভিত্তিক পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের মেডিকেল অফিসার আসিফ হোসেন বলেন, “রোহিঙ্গাদের এই রোগের ভয়াবহতা বোঝানো খুবই কঠিন। অনেক রোগী ডাক্তারের পরামর্শ মানে না, বিশেষ করে যৌন মিলনের সময়।” সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং এই ভয়াবহতার আরও অবনতি রোধ করতে তাদের যৌন মিলনের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে উত্সাহিত করা।
তারা আরো বলেছে যে, বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা খাতকে শক্তিশালী করতে হবে যাতে নতুন এইচআইভি রোগীদের সনাক্ত করে চিকিত্সা করা যায়। বিশেষজ্ঞরা এইচআইভিকে অগ্রাধিকার দিয়ে পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং এই সংস্থাগুলি এইচআইভি শনাক্ত করতে রোগীদের সহায়তা করছে।
কিন্তু লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি, এই উদ্যোগগুলি এইচআইভি স্ক্রীনিংয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
চিকিৎসক আবদুল মতিন বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এইচআইভি স্ক্রিনিং সেন্টার বাড়ানো দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র-ভারত ও মায়ানমার- দুটোই এইচআইভির জন্য বিপদজনক অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে এমন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়ও বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। মায়ানমার থেকে আসা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি ইতিমধ্যেই শনাক্ত করা হয়েছে, যে দেশটি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত নয়, তারা বলেছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এইডসমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এমনকি বিভাগীয় শহরেও এই রোগের চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল। তাই, তারা সংক্রামক রোগের চিকিৎসা, এইচআইভি পরীক্ষা ও কাউন্সেলিং, পজিটিভ লিভিং কাউন্সেলিং, পুষ্টি এবং নিরাপদ যৌন উপকরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ওপর জোর দেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ মোঃ আবু জাহের আইএনবিকে বলেন, “NSSTD প্রোগ্রামটি মূলত সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি প্রোগ্রাম। এটি ঢামেক হাসপাতালের উদ্যোগ নয়। রোগের চিকিৎসার বৈশ্বিক তহবিল বন্ধ এবং বেসরকারি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সরকারের কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অক্টোবর ২০১৪ থেকে নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত এইচআইভি আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৬৯ জন। তাদের মধ্যে ৯৫ জন রোগী মারা গেছেন।
এছাড়াও, ১৯৮৯ সাল থেকে মোট ৪,১৪৩ জন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং কমপক্ষে ৫৬৯ জন এইডস রোগের কারণে মারা গেছে।
আর এ/ এম ইউ কে