পেলে
আমাদের ছেলেবেলাটা ছিল ফুটবলময়। বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর দেশে আবাহনী-মোহামেডান ছিল আমাদের আনন্দের উৎস। আর বিকেল হলেই ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়া। আমাদের শৈশবকে এমন আনন্দময় করার কৃতিত্ব পুরোটাই পেলের। মানে ফুটবলের রাজার। সম্ভবত ক্লাস ফাইভের পাঠ্যবইয়ে পেলেকে নিয়ে একটা লেখা ছিল। ওটা পড়েই আমরাই পেলেকে চিনেছি, ফুটবলকে বুঝেছি। পেলের পুরো নাম এডসন আরান্তেস দি নাসিমান্তো। ছেলে বেলায় তার বাবা-মা’র প্রতি আমরা খুব ক্ষিপ্ত ছিলাম। ছেলের এত কঠিন নাম রাখতে হবে কেন। পরীক্ষা পাশের জন্য এই কঠিন নামটি আমাদের মুখস্ত করতে হয়েছিল। তবে আমার মত বিশ্বের কোটি মানুষের কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। বিশাল নামটা হারিয়ে গিয়েছিল ছোট্ট পেলের আড়ালে। মজাটা হলো পেলে নামটা কিন্তু তার পছন্দ ছিল না। ছেলেবেলায় বন্ধুরা তাকে ক্ষেপাতো ব্রাজিলের এক গোলকিপার 'বিলে' নামে। সেটিই পরে হয়ে গিয়েছিল পেলে। আর কালক্রমে পেলেই হয়ে গেল ফুটবলের অপর নাম।
হাজার মাইল দূরের একটি দেশের একজন ফুটবলারের জীবনী কেন বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে রাখতে হবে। এই প্রশ্ন অনেকের মনে আসতে পারে। কিন্তু পেলে নিছক একজন ফুটবলার ছিলেন না, নিছক একটি দেশের ছিলেন না। ফুটবলকে বিশ্বের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে দেয়ার কৃতিত্ব পেলের। ফুটবল যে নিছক একটি খেলা নয়, বিনোদনের উপলক্ষ্য, পেলে সেটা সবাইকে বুঝিয়েছেন। বস্তি থেকে উঠে এসে ফুটবলের রাজা হওয়ার যে পথ, সেটি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বিশ্বের কোটি মানুষকে।
পেলেময় ফুটবল বিশ্বে প্রথম ভাগ বসাতে এলেন ডিয়েগো ম্যারডোনা, ১৯৮৬ সালে তার জাদুকরী নৈপূণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে। রাজার বিশ্বে ফুটবল পেলো এক রাজপুত্র। আমি সবসময় বলি, টিভিতে সরাসরি যাদের খেলা দেখেছি, তাদের মধ্যে ম্যরাডোনাই সেরা। পেলের সময়ে ফুটবল খেলা সম্প্রচার বা রেকর্ডের ভালো সুবিধা ছিল না। কিন্তু তাও ইউটিউবের সুবাদে ছিটেফোটা যা দেখেছি, তাতে বুঝেছি, পেলে আসলে অন্যগ্রহের। আমরা তো সরাসরি পেলের খেলা দেখিনি, যারা দেখেছেন, তারা মেনেছেন পেলের শ্রেষ্ঠত্ব। সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় জার্মানির ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ার বলে দিয়েছেন শেষ কথাটি, ‘পেলে সর্বকালের সেরা। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। বাকি সবাই- ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ইয়োহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি সবাই তার নিচে। পেলের সঙ্গে তুলনা করার মতো কেউ নেই।‘
পেলের জীবন ছিল ফুটবলময়। কাতার বিশ্বকাপ চলার সময় তিনি হাসপাতালে ছিলেন। তখনই তার প্রাণসংশয় ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মৃত্যুর খবরও এসেছে। তখন কাতারে সবাই খেলার পাশে রাজার জন্য প্রার্থনা করেছেন। বিশ্বকাপের আনন্দকে নিজের মৃত্যুতে মাটি করতে চাননি বলেই হয়তো বেঁচেছিলেন আরো কিছুদিন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে এলো সেই খবরটি- পেলে আর নেই। গোটা বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন ফুটবলের রাজা।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও বুঁদ হয়েছিলেন ফুটবলেই। সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন সবাইকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের শেষ স্ট্যটাসেও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, মেসি আর এমবাপ্পেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। মরক্কোর রূপকথায় মুগ্ধতার কথা বলেছেন। বিশ্বকাপের সময় না হলেও ফুটবলের রাজার বিদায়টা যে কাছেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। ফুটবলের মাঠে অনেক লড়াই জিতলেও জীবনের শেষ লড়াইয়ে কোলন ক্যান্সারের কাছে হেরে গেলেন ৮২ বছর বয়সে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জিতেছেন। তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, যার দুটি আবার টানা। হাজারের বেশি গোল করেছেন। এমন কৃতিত্ব আর কারো নেই। কিন্তু এসব নিছকই পরিসংখ্যান, পেলের কাছে যা তুচ্ছ। পেলের কৃতিত্ব তার সৃষ্টিশীলতায়, সৌন্দর্য্যে। ফুটবলকে তিনি শিল্পে উত্তীর্ণ করেছিলেন। কিংবদন্তি ফুটবলার এরিক ক্যান্টোনা বলেছেন, 'আমার চোখে তিনি একজন শিল্পী। যিনি অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালাতে পারেন। ১৯৭০ সালের ফাইনালে কার্লোস আলবার্তোকে দেওয়া পাসটির সঙ্গে আমি তরুণ র্যাবোর কবিতার কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না।' আরেক কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাস বলেছেন, 'ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হলেন ডি স্টেফানো। আমি পেলেকে কোনো শ্রেণিতে রাখতে চাই না। তিনি সে সবার উর্ধ্বে।' ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ বলেছিলেন, 'পেলে একমাত্র ফুটবলার, যিনি যুক্তির দেয়াল ভেঙে দিয়েছিলেন।
কিংবদন্তিদের মুগ্ধতা আসলে ফুরাবে না। পেলে ছিলেন কিংবদন্তিদেরও কিংবদন্তি। পেলেই ফুটবলের শেষ কথা। তিনি সবকিছুর অনেক উর্ধ্বে। নিজের সম্পর্কে পেলে বলেছিলেন, 'বিটোফেনের জন্ম যেমন সঙ্গীতের জন্য, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর যেমন ছবি আঁকতে; তেমনি আমার জন্ম হয়েছে ফুটবল খেলার জন্য।
পেলের প্রতি মুগ্ধতা ছিল সবার। এমনকি প্রতিপক্ষও তাকে ভালোবাসতো। পেলের কাছে হেরেও যে সুখ। ১৯৭০এর বিশ্বকাপের ফাইনালে পেলেকে ঠেকানোর দায়িত্ব ছিল ইতালির ডিফেন্ডার বার্গনিচের। ফাইনালের পর তিনি যেন নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, 'আমি ভেবেছিলাম সেও (পেলে) আমাদের মত রক্তসাংসের মানুষ। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম।'
পরিসংখ্যানেও পেলে সেরা। তবে তিনি যদি তিনটি বিশ্বকাপ নাও জিততেন, হাজারের বেশি গোল নাও করতেন; তবুও তিনি সবার সেরা থাকতেন। কারণ মাঠে পেলে যা করতেন, তা ছাড়িয়ে যেতো সব কল্পনাকেও। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে তিনি ফুল ফোটাতেন। গোল হয়নি পেলের এমন অনেক মুভও ঠাঁই পেয়েছে মুগ্ধতার তালিকায়। জয় নয়, শ্রেষ্ঠত্ব নয়; পেলে মাঠে নামতেন আনন্দ পেতে, আনন্দ বিলাতে।
বছর দুয়েক আগে ম্যারাডোনার মৃতুর পর পেলে বলেছিলেন, অপেক্ষা করো আমি আসছি। স্বর্গের বাগানে দুজন ফুটবল খেলবো। ম্যারাডোনার অপেক্ষা ফুরালো। মর্ত্যধামকে শূন্য করে রাজা আর রাজপুত্র এখন স্বর্গের বাগানে ফুটবলের ফুল ফোটাচ্ছেন। আমরা বলছি বটে, পেলে মারা গেছেন। কিন্তু পেলের আসলে মৃত্যু নেই। প্যারাগুয়ের লাতে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল ফেডারেশনের সামনে পেলের ছবির নিচে জন্মসাল ১৯৪০ লেখা হলেও মৃত্যু সালে অসীমতার চিহ্ন। পেলে আসলে জাগতিক সময়ের হিসাবের উর্ধ্বে।
ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কাফুর কথা দিয়েই শেষ করি, ' পেলে মৃত্যুবরণ করেছেন, এ কথা ঠিক না। পেলে কখনো মরবেন না, পেলে কখনো আমাদের ছেড়ে যাবেন না। পেলের শেষ নেই। পেলে চিরন্তন, পেলে রাজা, পেলে অনন্য। উনি একটু বিশ্রামে গেছেন, এই যা। অনন্ত বিশ্রামে থাকুন প্রিয় পেলে। আমাদের ভালোবাসা থাকলো সাথে।