এতোদিন ধরে শুনে আসছি, কাকের মাংস কাকে খায় না। বাস্তবে কাক তার মাংস না খেলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ঘটনাক্রমগুলো কাক তার মাংস খাওয়ার চেয়েও বেশি কিছু।
বয়স হবার পর থেকে জেনে আসছি- আদালতের বিরুদ্ধে কোন কথা বলা যায় না। সামাজিকভাবে বলার রীতি নেই। এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সেটা হয় আদালত অবমাননার সামিল; অথচ অতি সম্প্রতি দেশে একজন আইনজীবির বিরুদ্ধেই নয় কেবল, একেবারে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধেই কথা হচ্ছে। আসামী করে আদালতে অপরাধী প্রমাণ করা হচ্ছে প্রাক্তন একজন প্রধান বিচারপতিকে।
আমি বলছি না এমন ঘটনায় প্রধান বিচারপতি (প্রাক্তন)'র উপর ন্যায় বা অন্যায় করা হয়েছে। তবে এটা প্রচলিত ধারাবাহিকতার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু ঘটিয়েছেন বর্তমান আদালতের বিচারপতিগন, সে কথা-ই বলছি। কেউ হয়তো এক্ষেত্রে বলার চেষ্টা করছেন, আইন সকলের জন্য সমান। এমন কথা অনেক আগে থেকেই শুনে আসছি। তাই নতুন করে উল্লাসিত হবার কিছু দেখছি না এতে।
আমার কাছে বিষয়টি মনে হয়েছে, কাকের মাংস কাকের খাওয়ার সামিল অথবা তার চেয়েও বেশি বৈকি। তারপরেও পরিবর্তনের ধারা শুরু করায় সাধুবাদ জানাচ্ছি সংশ্লিষ্টদের। এখন থেকে সকলের জন্যই যেন আইন সমান হয়। সেই প্রত্যাশা করছি।
সম্প্রতি পুলিশ বিভাগকে নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায়। যা শোনার পর মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ এই পুলিশ বিভাগকে নিয়ে এগুলি অযাচিত। আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে গুরুত্ব পাচ্ছেন পুলিশ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। শুধু তাই নয়। কথা উঠেছে-কোনো কোনো কর্মকর্তা কোনো বিশেষ দেশের সমর্থন বা পক্ষ অবলম্বন করছেন বা কোনো বিশেষ ব্যক্তির সাথে সুসম্পর্কে বজায় রেখে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে কাজ করছেন। এমন কথা চাউর হচ্ছে বলেই আমার এ কথাগুলো বলা।
পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে কোনো কথা আলোচনা কিংবা সমালোচনায় আসা দোষের না। এখানে সবই ঠিক ছিলো যদি যে কোন মানুষের প্রয়োজনে কাছে এদেরকে কাছে পাওয়া যেত বন্ধুর মতো বিশ্বাসের জায়গা থেকে। এই বিভাগে নিজেদের মধ্যে যে কতো কিছু ঘটছে, এসব ঘটনার কথা মানুষ সহজেই জানতে পারছেন নানাভাবে। এখানে বলে রাখা ভালো- সরকারী এসব বিভাগের ভিতরের তথ্য বাইরের কারো পক্ষে জানা সম্ভব হতো না, যদি না নিজেদের অস্তুিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ক্ষমতার লড়াইয়ে না জড়াতেন। এখানেও সেই একই কথা বলা চলে যে, কাকের মাংস কাকে খাচ্ছে।
বাকি আছে সাংবাদিক। একসময় আমি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে পছন্দ করতাম। এখন আর কাউকে পরিচয় দিতে গেলে সাংবাদিক কথাটি বলি না।
অতি সম্প্রতি দেশের সংবাদ মাধ্যম আর সংবাদ কর্মীদের নিয়ে যে মুখরোচক কথা চারিদিকে ছড়াচ্ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তা দেশের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহত এবং অশনি সংকেত।
দেশে এক শ্রেণীর সাংবাদিক আছে যারা তাদের স্বার্থের জন্য কর্তা ব্যক্তিদের তেল দিতে দিতে নিজেদের পেশাদারিত্বের কথাও ভুলে গেছে। তাদের তেলবাজিতে দেশে এখন এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে, দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই রাগে, দুঃখে, অভিমানে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, সাংবাদিক তো নয় যেন সাংঘাতিক। (কথাটি ঘুরিয়ে বলেছি)। তাহলে আমাদের দেশের সাংবাদিকদের অবস্থা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে; বুঝতেই পারছেন। যেখানে সাংবাদিকদের বলা হতো সমাজের দর্পণ, সেখানে দর্পণ কি হতে পারছে সাংবাদ কর্মীরা? প্রশ্ন অনেক জোরালো, অথচ উত্তর নেই!
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই তিনটি সেক্টর খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের কাছে বিশ্বাস আর আস্থার শেষ আশ্রয়স্থল তথা নিরাপদের। অথচ এগুলো আজ অনিরাপদ আর অনাস্থাতে ভরপুর।
আমার বিশ্বাস একটি দেশ ও দেশের জনগণকে মাথা উচু করে বাঁচতে শিখাতে পারে এই তিন মাধ্যমের সদস্যরা। অথচ এরাই যদি হয় অসাধু আর দুর্নীতিগ্রস্ত তাহলেতো আমাদের সাধারণ মানুষের কি করার থাকে।
আমার ধারনা, বাংলাদেশ এখন একজনের নির্দেশে চলছে। তিনি হচ্ছেন সরকারের প্রধান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তা-ই যদি হয়, তাহলে আমি কি এটাই ভাববো, এই তিন সেক্টরের আজকের যে দ্বৈর্নদশা এর পিছনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশ, নির্দেশ, ইশারা কিংবা ইন্ধন রয়েছে?
দেশে দায়িত্বশীল কারো সাথে কথা বললে তারা বলেন, দেশের ভিতরকার অবস্থা খুব বেশি ভালো নেই। দেশে রাস্তা হচ্ছে, ব্রিজ হচ্ছে, কালভাট হচেছ। বাস্তবে যা হবার কথা, যা দেশবাশীর প্রত্যাশা বা প্রয়োজন, তা হচ্ছে কি?
অতি সম্প্রতি দেশে একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলো। নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনা করলে বলা যায় আওয়ামী লীগ তথা সরকারের বিজয় হয়েছে। তবে পরাজয় হয়েছে দলটির নেতার নীতি আর আদর্শের। এজন্য প্রথমেই বলা যায়, সেম সাইড মারামারি। যা কিনা মেনে নেবার মতো নয়। সরকারী দলের কর্মীদের সাথে পুলিশের লাঠিপেটা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। দ্বিতীয়তঃ নৌকার প্রতীক পেয়ে দলটির আদর্শের বাইরের কারো অংশ গ্রহণ এবং বিজয়। তৃতীয়তঃ নির্বাচনে বিরুদ্ধ দলের অংশ গ্রহণে পরিবেশ তৈরি করতে না পারা।
এসব বিষয়ের নিখুত পর্যালোচনা করার সুযোগ এখন নেই। দেশে ক্ষমতাশীন দলের মন্দ কাজ আর ব্যর্থতার সমালোচনা করা মানে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন তাদের বিরোধিতা করা। সমালোচনা আর বিরোধিতাই যদি তারা না বোঝেন, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ আমজনতার মত প্রকাশের সুযোগ থাকলো কোথায়?
এসব হচ্ছে কেবল উপরে উল্লেখ করা দেশের প্রধান তিনটি বিভাগের ব্যর্থ পরিচালনা বা ইচ্ছাকৃত ভুল পথে অগ্রসরের ফলাফল। এসব থেকে মুক্তি পাবার প্রথম পথই হচ্ছে মুক্তমত প্রকাশের সুযোগ। আলোচনাগুলোকে সঙ্গী করে সমালোচনার প্রতি নজর দেয়া।তা না হলে ক্রমেই আমরা ডুবে যাবো অন্ধকারে।
দেশে আমাদের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। বাস্তবে যা হচ্ছে তার প্রয়োজন আছে। এসব উন্নয়ন হচ্ছে সময়ের সঙ্গে ভৌগোলিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা মাত্র। এর বাইরে আরো অনেক কিছু হচ্ছে যা প্রয়োজনের দিক থেকে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলোর গুরুর্ত্ব দিয়ে অতি দ্রুত কাজ না করলে একসময় আরো বেশি সমস্যা তৈরি হবে দেশের অভ্যন্তরে। তখন আর কাক তার মাংস ছাড়া কিছুই খাবে না, হয়তো খাওয়ার কিছু থাকবেও না।
পি আর প্ল্যাসিড
জাপান প্রবাসী সাংবাদিক-লেখক