ছবি:টোকিও বাংলা নিউজ
খড়ের বেনিতে মাটির আস্তরে তৈরি করা গণেশ ঠাকুরের কোলে আমাদের মহা পবিত্র কোরআন শরীফটি প্রচ্ছদ দৃশ্যমান করে উম্মুক্ত ছিলো।সাতসকালে হিন্দুরা ওই মন্দিরে আসার আগেই সেখানে কথিত পরহেজগারী মুসলমান গিয়ে হাজির হলেন মন্দির দর্শন করতে। সঙ্গে লাইভ ভিডিওর প্রস্তুতিও ছিলো। মুহুর্তেই সামাজিক মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়ে হীনস্বার্থ হাসিল করলো। দেশের বাইশটি জেলায় দুর্গা মন্দিরে হামলা হলো। হাজিগন্জে গুলিতে চারটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল! বাহ্ কি চমৎকার এক তৌহিদের স্রোতে আমরা নিজেদের জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে চলেছি।
'এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ ' কথাটি লেখা থাকলেও বাঙালি সেখানে প্রস্রাব করে। একই কথা আরবী হরফে লিখে দেয়ার পর বাঙালি সেখানে প্রস্রাব করতে বসে লেখাটি চোখে পড়লেই কাপড় ভিজিয়ে উঠে পরে। অন্ধ ধার্মিকের দেশ বলে আমাদের অবস্থাটা এখনো তেমনি।
পবিত্র কোরআন আরবী হরফে লেখা। আরবী একটি জাতির ভাষা মাত্র। এই ভাষাতেই পবিত্র কোরআন লিপিবদ্ধ হয়েছে। আমরা কোরআনকে অনেক বেশি বেশি ভালোবাসি, কিন্তু কোরআনের কথামতো চলি না। আমরা তাহলে কি?
মাদ্রাসায় পরীক্ষার সময় কোরআন হাদিসের আয়াত পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় টয়লেটে পাওয়া যায়। ছেলে মেয়েদের অন্তর্বাসে থাকে নকল হিসেবে। আমরা তখন মান্যতা আর অবমাননার কথা ভুলে যাই। শুক্রবারে প্রধান সড়কে রাস্তা বন্ধ করে এম্বুলেন্স আটকিয়ে নামাজ আদায় করি। জায়নামাজটি বগলে রেখেই মহল্লার এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঘুরে প্রদর্শন করে বুঝাতে চাই আমি ধার্মিক। টুপি জুব্বা গায়ে রেখে দেদারসে হাজারও খারাপ কাজ করি।
কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন শরীফটি হিন্দু দেবতা গণেশ ঠাকুরের কোলেই ছিলো। পবিত্র কোরআন সমগ্র পৃথিবীর জন্য। ওই প্রাণহীন গণেশ ঠাকুরের কোলে কোরআান যেই রাখুক, তাতে আমি অবমাননা দেখছি না। কারণ কোরআন যদি হিন্দু বা হিন্দু দেবতা গ্রহণ করে তাতে আমার সমস্যার কিছু নেই । কেউ যদি কোরআনের আশ্রয় নেয় তাতে তো মুসলমানদের খুশি হবারই কথা। মূলত ষড়যন্ত্রকারীরা যাদের দিয়ে কাজটি করেছেন তারা বুদ্ধিমত্তায় চতুর ছিলেন না। চতুর হলে গণেশ ঠাকুরের পায়ের কাছেই রাখতেন। ছবিতে আমরা তাই দেখতে পেতাম। কিন্তু তবু আমরা এই অধর্মের অন্ধকূপে ডুবে গেলাম। যা হবার তা-ই হলো। সাতচল্লিশের দেশবিভাগের আগে ও পরে যা হয়ে আসছে তা আরো হবে।
তবে আমরা কোরআনের প্রকৃত অনুসারী হতে না পারলেও কাগজে মোড়ানো সুন্দর প্রচ্ছদের এই পবিত্র ধর্ম গ্রন্থকে লৌকিকতায় প্রচন্ড রকমের ভালোবাসি। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হুজুর হাফেজরা এর ভুলভাল ব্যখ্যা করে আমাদের আপাদমস্তক মানুষ থেকে উগ্র মুসলমান হিসেবে তৈরি করার খ্যাতি জুগিয়েছেন।
অল্পস্বল্প শিক্ষায় যদ্দুর জানি পৃথিবীতে কোরআন বা কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ অবমাননা করার সুযোগ কারোরই নেই। পৃথিবীর সবকটি ধর্মীয় গ্রন্থ নিজস্ব শক্তির বিশ্বাসে প্রকান্ড আর পরমতসহিষ্ণু। অবমাননা বলতে আমরা সাধারণ জ্ঞানে যা বুঝি, তা হলো তাচ্ছিল্য করা বা সম্মান প্রদর্শন না করা। কেউ যদি ঘৃণিত সে কাজটি করে থাকেন তার বিচার আল্লাহই তো করবেন। আসলে মান্যতা আর অবমাননার পার্থক্য অনেক ফারাক। প্রেসে যখন ছাপা হয় তখনকার রূপ আর সম্মিলিত গ্রন্থ বাঁধাই হওয়ার পরের রূপও আলাদা। কিছু সাদাকাগজে কালো হরফ একত্রিত হয়ে একজন মুসলমানের পরলৌকিকতা আর জীবনাচরণে বিশ্বাসের স্তম্ভ তৈরি করে কোরআন। আবার এই কোরআন ছোট আকারে মাদুলিতে ঢুকে কখনো সখনো রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায়ও পাওয়া যায়- বিশ্বাসীরা তা যত্ন করে আবার সংরক্ষণও করেন।
মহাপবিত্র এই কোরআন পৃথিবীর সব মানুষের জন্য। শুধুমাত্র মুসলমানের জন্য নই। কোরআন মুসলমানরা বিশ্বাস করে, ভালোবেসে বেশি বেশি চর্চা করে।
প্লিজ মহাপবিত্র এই গ্রন্থটি নিয়ে ষড়যন্ত্র বন্ধ করুন। পৃথিবীতে কোরআন বা ধর্মীয় সব গ্রন্হই পারমাণবিক বোমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। এ দিয়ে বর্তমান পৃথিবীতে অনেক ধংস ডেকে আনা যায়- কারণ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের মানুষকেই শাসকরা ধর্মের অন্ধকূপে বসতি গেঁড়ে দিয়েছেন। এতে শাসকদের বেশি বেশি লাভ। মান্যতা বা অমান্যতার বিচার তো তিনিই করবেন। আপনি আমি কেন বিচারের দায় কাঁধে নিবো!
আসলে আমরা ধর্মকে এখন পরলৌকিকতার চেয়ে সামাজিক আচারে আর নিজের স্বার্থেই বেশি ব্যবহার করছি। যে কারণে এর নিগুঢ়ে যেতে পারছি না বা যাই না। পৃথিবীতে আস্তিকদের পরের ধাপেই নাস্তিকদের সংখ্যাগত অবস্থান। একবিংশ শতকে ধর্মের অবস্থান কোন পর্যায়ে তা অনুমান করতেই এ তথ্য সংযোগ করলাম। এ বিষয়ে আরো একটি সাধারণ ব্যখ্যা আছে তা না ই বললাম।
এগারশ শতকে ইরাকের সম্রাট হুজ্জাজ দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা থেকে মসলা আমদানি করে ইউরোপে ব্যবসা করতেন। সম্ভবত ১১০১ সালে ততকালীন ভারতবর্ষের (বর্তমানে পাকিস্তানের) সিন্দু প্রদেশে হুজ্জাজের মসলাবাহী বাণিজ্যজাহাজ নোঙর করা অবস্থায় দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। দস্যুরা জাহাজের সব মালামল লুট করে নেয়।
ইরাকের সম্রাট হুজ্জাজ সিন্দুর রাজার কাছে এর প্রতিকার না পেয়ে সিন্দু আক্রমণ করে তার দখল নেয়। হুজ্জাজের প্রধান সেনাপতি সম্ভবত মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্দুর অধিপতি নিযুক্ত করেন। এরপর আফগানের সুলতান গজনবী থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। পবিত্র কোরআনের আদর্শিক আকর্ষণ আর মুসলমান শাসকদের হাত ধরে সুফী সাধকরা সুলতানী আমল মুঘল আমলসহ কয়েক শতাব্দী জুড়ে ভারতবর্ষে শান্তির ধর্ম ইসলামকে আর্যদের হৃদয়ে প্রোথিত করতে সফল হয়। পরমতসহিষ্ণু পবিত্র কোরআনের বাণী দক্ষিণপুর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মনে এক নবজাগরণ তৈরি করে। সতীদাহ প্রথা, উচ্চ বর্ণ, নিম্নবর্ণ, আর হিন্দু রাজাদের শোষণের জাল ছিড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ আর্য সনাতন ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। হাজার বছর ধরে শান্তিতে বসবাস করা বিভিন্ন জাত গোত্রের মানুষের মাঝে আজ যে বিভ্রান্তির ধর্মীয় উম্মাদনা তার জন্য কেবল শাসকদের উদাসীনতাই দায়ী।
বৃটিশ ওপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েই এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মীয় বিভক্তিতে জড়িয়ে পরে। ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গায় চার হাজারের বেশি হিন্দু মুসলিম প্রাণ হারায়। এরপর দ্বি জাতি তত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়। কিন্তু ধর্মের নামে অধর্মের বিষ এখনো চাষাবাদ অব্যাহত রেখেছে শাসকশ্রেণি। সমাজনীতির সঙ্গে শিক্ষানীতির ব্যাপক সাংর্ঘষিকতা জিঁইয়ে রাখা হচ্ছে যুগ যুগ ধরে।
সাধারণ শিক্ষা থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে দূরে রেখে ধর্মের আসল চাকচিক্য বা ভালোমন্দ থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে প্রজন্মকে। একমুখী ধর্মীয় শিক্ষার আড়ালে সব সম্প্রদায়ের মাঝে গড়ে উঠছে উগ্র মতবাদের বিদ্বেষি প্রজন্ম। যার বিস্ফোরণের শিকার হই আমরা বার বার। আর এসবের পেছনে কাজ করছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উগ্র চক্র। যারা কখনো শাসক শ্রেণির আবার কখনো নিজেদের হীনস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতবাদ প্রচারে এতটা লাগামহীন আর অশ্লীল যে, ধর্ম যেন এখন তাদের কাছে ব্যবহারিক এক নিত্যপণ্য। এরা প্রতিমুহূর্তে ওয়াজ মাহফিলে, ইউটিউব চ্যানেলে বেহেশত বেচা কেনা করে। ধর্মজ্ঞানহীন এ দেশের সহজ সরল মানুষ তা গোগ্রাসে গিলছে প্রতিদিন। দেশের সমাজসেবা বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বসে বসে তামাশা দেখছেন।
কিছু কিছু মুফতি মাওলানারা যেন ইসলাম ধর্ম আর বেহেশত কেনা বেচার ইজারা নিয়েছেন।
বুখারী শরীফ মুসলিম শরীফের একই আয়াতের ভিন্ন ব্যাখার বাহাস করে চলেছেন তারা।
ধর্মের এই বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে একটি পরমতসহিষ্ণু ধর্মীয় রীতির চর্চা এবং সব ধর্মের মূল গ্রন্থের পুর্ণ জ্ঞান যদি আমাদের জানা থাকতো হয়তো ধর্মীয় বিভেদ আজ এতটা ভয়ঙ্কর হতো না।
রাষ্ট্র কি সম্প্রীতির বন্ধনে সেই ব্যবস্থা করবে? নাকি শাসনসুযোগের সেই ধারাতেই রেখে দিবে। আমরা অধর্মের এই অন্ধকূপ থেকে মুক্তি চাই- মুক্তি চাই।
ঢাকা
আর সি