
ফাইল ছবি
তাঁকে ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন নজরুল। লিখেছিলেন – ‘আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রাণী, আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতি পত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কী সম্মান করিব?
সেই নারী, অর্থাৎ ফজিলতুন্নেসা নজরুলের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আহত নজরুল পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন ‘সঞ্চিতা’। অবশ্য সেই সংকলনে রয়েছে একটি গান, যেটি ফজিলতুন্নেসার বিলেত যাওয়ার আগে, বিদায়-সংবর্ধনার উপলক্ষে লেখা। ফজিলতুন্নেসা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের ছাত্রী। তিনিই মুসলিম বাঙালি নারীদের মধ্যে প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী। ফলে, পড়াশোনায় তাঁর অর্জন নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে না। মাস্টার্সের পর, উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন তিনি। সেখানেই তাঁর সঙ্গে প্রেম হয় খুলনার এক যুবকের সঙ্গে। দেশে ফিরে, বিয়ে করেন তাঁরা। আর নজরুল? ফজিলতুন্নেসার বিয়ের খবর পেয়ে গান লেখেন –
ফজিলতুন্নেসার প্রতি নজরুলের এই যে অনুরাগ, বলা ভালো, প্রেম – তা কি একপাক্ষিক ছিল? নজরুল-গবেষকরা একবাক্যে জানিয়েছেন হ্যাঁ। ফজিলতুন্নেসার পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্রয় বা আকর্ষণই ছিল না নজরুলের প্রতি। থাকবেই বা কেন! ফজিলতুন্নেসা তখন মেধাবী এক ছাত্রী, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাঁর সামনে। আর নজরুল বিবাহিত, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রয়েছে ভরাট সংসার। নজরুলের প্রেমকে প্রশ্রয় নিয়ে নিজের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করতে চাননি ফজিলতুন্নেসা।
চিঠির সর্বাঙ্গে ফুটে রয়েছে এক বিনম্র প্রেমিকের ভয়-মিশ্রিত কথা। যেন ফজিলতুন্নেসা বিব্রত, বিরক্ত – তবু নজরুল নিজেকে সামলাতে না পেরে অসহায় হয়ে লিখেছেন চিঠিটি। অথচ ফজিলতুন্নেসা যতই বাংলার প্রথম এম এ ডিগ্রিধারী মুসলিম বিদুষী হোন, নজরুলও কিন্তু সে-সময়কার অন্যতম প্রধান কবি। আরও দৃপ্ততা আশা করাই যেত কবির কাছ থেকে। তবে কি প্রত্যাখ্যাত হয়ে এতই আঘাত পেয়েছিলেন যে নিজেকে ভেঙেচুরে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো দিশা দেখতে পাননি তিনি?
কবির হৃদয় দুর্জ্ঞেয় হতে পারে, প্রেমিকের হৃদয় নয়। নজরুলের প্রেমিক-সত্তাটিকে চেনা যায় এই আচরণের মধ্যে দিয়েই। তিনি ভালোবেসেছিলেন। তিনি ভালোবাসতে পারেন। তাই তিনি কবি।
আপন দেশ / সাহিত্য / বিলাস